আমার জানা স্বত্বে পুরুষ রাশি বলতে কোন রাশি নেই। তবু আমার বার বার মনে হয়, আমার হয়তো পুরুষ রাশি। এমনটা মনে হবার অনেক কারণ আছে। যেমন, যেসব ছেলেদের কন্যা রাশি, অদের কে মেয়েরা সহজেই পছন্দ করে। আর আমার যদি পুরুষ রাশিই নাই হবে, তবে এতো এতো পুরুষ আমায় কেন পছন্দ করবে? মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি। দশম শ্রেণীতে পরি, নাম নিয়ে বিতর্ক আছে। আমার অজস্র নাম। সব গুলো পারার ছেলেদের দেওয়া। তবে অরিজিনাল নাম-মায়া। চেহারার ভিতর মায়া-মায়া ভাব আছে কি না এতে ও সন্দেহ। তবে এক সময় ছিল। বর্তমানে পারার ভদ্র-অভদ্র ছেলেদের বিরক্তে অতিষ্ঠ হয়ে আমার চেহারায় রাগি ভাবটা সব সময় বিরাজ মান। আমার চুল গুলো কোমর পর্যন্ত ভেসে বেড়ায়। গায়ের রং ফর্সা। চোখ নাকি হরিণের মতো সুন্দর। এটা পারার ছেলেদের কথা। আর চোখ সম্পর্কে আমার ধারনা বাঘের মত নিষ্ঠুর। সকালে স্কুলে যেতে এবং আসতে, পারার ছেলেদের অনেক কথাই আমাকে হজম করতে হয়। করি। উপায় নেই। পরিবারে আমরা চারটি বোন। ভাই নেই বলে প্রতিবাদ করার ও তেমন কেউ নেই। বাবা বৃদ্ধ বলে উনাকে এসব জানাই না। বেচারা অল্প আয়ের মানুষ। সারাদিন অফিস করে এসে ক্লান্ত হয়ে যায়। তার উপর এসব কথা শুনলে হার্ট এ্যাটাক করে মারা যাবে। তাই জানাতে পারি না। মা যদি ও কিছুটা বুঝতে পারে। কিন্তু বাবাকে জানাতে দেয় না। আমার অন্য তিনটি বোনের গায়ের রং একটু ময়লা বলে, ওদেরকে আমার মত কেউ বিরক্ত করে না। যত যন্ত্রণা সব আমার উপর। স্কুল সময়ের রুটিন অনুযায়ী রাস্তার মাঝে অসংখ্য ছেলে আমার জন্য অপেক্ষা করে। বাসা থেকে বের হবার পরই একটা দল বসে থাকে। তার পর আমাকে লক্ষ করে ওদের মনের সব কথা-ব্যকুলতা ঝাড়তে থাকে। কেউ বলে রানী, কেউ বলে ঐশ্বরিয়া, তোমাকে বড় বেশি ভালবাসি। কেউ কেউ ছোট কাগজে প্রেম পত্র লিখে ছুড়ে মারে। গোলাপ ছুড়ে মারে। এগুলো আমার বুকে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে। ওরা হা করে তাকিয়ে থাকে। আমি চোখে গরম করে চলে যাই। ওরা পিছু পিছু স্কুল পর্যন্ত এসে চলে যায়। আমার সিলেবাসে এরা অভদ্র প্রেমিক। এবার আসি ভদ্র প্রেমিক দের কথায়। এরা একটু বেশি ভদ্রতা দেখায়। যাবার পথে সামনে এসে দাড়িয়ে বলবে-এই একটু শোন। থমকে দাড়াই। এরা সামনে এসে মাথা নিচু করে বলবে-এগুলো তোমার জন্য। নিলে খুশি হবো। সেখানে ডায়েরি, কলম, প্রেম পত্র, সি-ডি, গোলাপ ফুল সহ নানান রকম উপহার থাকে। আমি দুঃখিত। এগুলো নিতে পারবনা বলে চলে আসতে শুরু করি। অমনি ওরা পিছু পিছু আসে, প্লিজ নেও না। আমি আর ফিরে তাকাই না। সোজা বাসায় চলে আসি। বিকেল থেকে রাত আট টা পর্যন্ত বাড়ির সামনে সেই সব ভদ্র-অভদ্র প্রেমিক আমার জন্য ঘুরা ফিরা করে। ওদের দেখলে আমার বড় হাসি পায়। হয়তো বাসা থেকে দশবার করে আয়নায় মুখ দেখে এসেছে। কি হ্যান্ড সাম বয় ওরা। কিন্তু আমাকে ওরা দেখতে না পেলেই জোড়ে জোড়ে গান গাইবে। সিস দিবে। হট্টগোল করবে। মনে হয় আমাকে একবার দেখতে পেলেই ওদের রাতের ঘুমটা ভাল হয়। এই ভেবেই মাঝে মাঝে বিকেলে ছাদে উঠে ওদেরকে আমার পুরুষ রাশির মুখটা দেখাই। ঈদের চাঁদ উঠলে চাঁন রাইতে যেমনি আনন্দ হয় আমাকে দেখলে ওদের আনন্দ তেমনই হয়। কিন্তু ছাদে আমি বেশিক্ষণ না থাকায় বেচারারা এক নজর দেখতে পেলেই শুকরিয়া বলে চলে যায়। রাতে আমার আর বইয়ের ভিতর মন বসে না। তবু ও জোড় করে ক্লাসের পড়া মুখস্থ করি। নয়তো ক্লাসে যে সব প্রেমিক আছে ও দের কাছে লজ্জা পেতে হবে। ক্লাসে অনেক গুলো ছেলে আমার জন্য পাগল। ক্লাসে স্যার কি বললো সেদিকে ওদের নজর নেই। ওরা আনমনে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই জন্য কমল স্যারের হাতে অনেক জন মার ও খেয়েছে। কিন্তু ফায়াদা হয়নি। আমার বান্ধবীরা আমাকে খোঁচা মেরে বলে- দেখ মায়া ঐ যে আবুল তোর দিকে কত কষ্ট ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাই। আর ওমনি ধাক্কা খাওয়ার মত সোজা হয়ে বসে আবুল। কিন্তু চেহারার কষ্ট ভাবটা দূর হয় না। এমনি রুটিন মাফিক সব চলতে থাকে। অন্য পারার কিছু ছেলেকে ও আমাদের বাসার সামনে ঘুরা ফেরা করতে দেখা যায়। ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দেয়। এ কারণেই হয়তো এ পারার এবং ঐ পারার ছেলেদের মধ্যে একটা কঠিন মারা মারি হয়। আমি ভীতু হই। এই সবই তো আমাকে কেন্দ্র করে হচ্ছে। কিন্তু আমি কি করবো। আমার এই একটা মন আমি কয় জন কে দিবো ? ভাবতে পারি না। আশা নিরাশায় দোল খাই। রাতে এখন আমার ও ঘুম হয় না। বুঝতে পারি আমাকে কিছু একটা করতে হবে। এই জন্য যোগ্য এক জন ছেলে দড়কার। যে আমাকে চিরদিন একান্তই ভালবেসে আগলে রাখতে পারবে। কিন্তু এমন কাউকে খুঁজে পাই না। দিন যত যায় ভয় তত বাড়ে। একা চলতে পারি না। এক দিন আমার ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্র টি আমাদের বাসায় এলো। ওর আবার তোতলামি রোগ আছে। ঠিক মত কথা বলতে পারে না, ছাত্র খারাপ হলে ও ছেলে হিসেবে ও খুবই ভালো। শান্ত, নীরব। দেখতে মায়া ভরা চেহারা। কিন্তু গায়ের রং আমার বোনদের মতো ময়লা। ওর নাম হৃদয়। হৃদয় বাসায় টুকেই আমার হাতে একটা কাগজ দিয়ে চলে গেল। ওকে দেখে খুব বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল। কাগজটা আমি ওর হাত থেকে নিলাম দু"টি কারণে। এক ও তোতলা, মুখে বলতে সমস্যা হয় বলে কাগজে লিখে এনেছে। দুই ও আমাকে প্রেম নিবেদন করবে না এটা আমি নিশ্চিত। কারণ ওর ভিতরে তেমন কোন কিছুই লক্ষ করিনি। এই বিশ্বাস নিয়েই কাগজটা খুলে পড়লাম।
প্রিয় বন্ধু মায়া, মনকে অনেক বুঝিয়েছি যে, তোমাকে পাবার কোন যোগ্যতাই আমার নেই। কিন্তু পাগল মন বাঁধা, বারণ কিছুই মানতে চাচ্ছে না। ও কেবল তোমাকে চিরদিন বুকে আগলিয়ে রাখার স্বপ্ন দেখে। এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিত বুঝতে পারছি না। আমি জানি অনেক ছেলেরাই তোমাকে ভালবাসে, সেখানে তোমার কাছে আমার যোগ্যতা শূন্যতায় পরিপূর্ণ। সব জেনে বুঝে তবু লিখলাম। এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। আমি সবার মতো তোমার কাছে ভালবাসা চাইবো না। তুমি শুধু আমাকে একটা উপকার করতে পারবে ভেবেই তোমার কাছে আসলাম। খুব কষ্ট আর হতাশা নিয়ে আমার দিন কাটছে। তোমার ভালবাসা পাবো না এটা আমি নিশ্চিত। তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ। তুমি আমাকে আগামী কাল ক্লাসে সবার সামনে তিন বার বলবে, তুমি আমাকে ঘৃণা কর, ঘৃণা কর এবং ঘৃণা করো। আমার বিশ্বাস এই লজ্জা পেয়ে আমার মন আর তোমাকে চাইবে না। দয়া করে আমাকে মানসিক কষ্ট থেকে মুক্তি দাও। এর বেশি কিছু আমার চাওয়ার নেই।
তুমি বলবে বলে
এই প্রত্যাশায় হৃদয়।
পত্রটা পরেই আমার কেমন যেন খারাপ লাগল। নিজের মনটাকে আমি কিছুতেই বুঝাতে পারছি না যে এখন আমি কি করবো। রাতে হৃদয়ের পত্রটা আরো কয়েক বার পড়লাম। যতই পরি, ততই ওর জন্য মনের কোনে ব্যকুল টান অনুভব করি। পর দিন সকালে স্কুলে গেলাম। গিয়ে দেখি সবার পিছনের বেঞ্চ হৃদয় মাথা নিচু করে বসে আছে। ও সব সময় ওখানেই বসে। স্যার ক্লাসে আসতে এখনো অনেক সময় বাকি। বাকি ছাত্র-ছাত্রীরা হৈ চৈ করছে। আমি প্রথম বেঞ্চে ব্যাগটা রেখে সবাইকে বললাম তোমরা সবাই চুপ করো। আমি কিছু কথা বলবো। তখন সবাই চুপ করে যার যার স্থানে বসে পড়লো। হৃদয় তখন ও মাথা নিচু করে আগের মতই বসে আছে। আমি কোন কিছু না ভেবেই এক শত জন ছাত্র-ছাত্রীর সামনে চিৎকার করে বললাম-হৃদয় আমি তোমাকে ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি। সমস্ত ক্লাস তখন নীরব। ক্লাসের সবাই হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হৃদয় তখন ও সেই আগের মতো মাথা নিচে দিয়ে বসে আছে। আমি ধীর পায়ে হেটে ওর কাছে গেলাম। ও মাথা নিচু করেই উঠে দাঁড়াল। আমার হাত ধরে বললো-মায়া আমি তোমাকে এতো এতো বেশি ভালবাসি যা প্রকাশ করা আমার জন্য সত্যি খুব কষ্ট। আমি তোমাকে হারাতে চাই না। বলেই ও সকলের সামনে কেঁদে ফেললো। ওর কান্নায় সমস্ত ক্লাস আরো বেশি নীরব হয়ে গেল। সে দিন কোন রকম একটি ক্লাস করে আমি বাসায় চলে গেলাম। পরের দিন এ খবর চারদিকে বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়লো। পারার ছেলেরা তো রেগে আগুন। আমি ভয়ে ভয়ে স্কুলের দিকে পা বাড়ালাম। হঠাৎ একটা মোটর সাইকেল এসে আমার সামনে থেমে গেল। কিছু বুঝে উঠার আগেই একজন বললো তোর রূপ যৌবন আজই শেষ করে দিব। তার পরের ঘটনা আমি হাসপাতালের বেডে। আমার সমস্ত মুখমণ্ডল এসিডে ঝলসে দিয়ে পাষণ্ডরা পালিয়ে গেছে। বিচার পাইনি কারো কাছে। হৃদয় একবার এসেছিল আমাকে দেখতে, কিন্তু ভালোবাসতে নয়। হৃদয় কে বললাম এখন কি তুমি আমাকে ভালোবাসো? উত্তর পাইনি আজ ও। ওর নীরবতা আর আমার শূন্যতা এটাই এখন আমার চরম বাস্তবতা।
০১ ফেব্রুয়ারী - ২০১১
গল্প/কবিতা:
২১ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪